মৃত্যুর আগেই জীবনের হিসাব নিন

হাওর বার্তা ডেস্কঃ মুসলিম ব্যক্তির উচিত হলো হৃদয়ে উদয় হওয়া চিন্তা, ভাবনা ও বিভিন্ন কুমন্ত্রণার ক্ষেত্রেও নিজের মনের হিসাব নেওয়া ও এর সঙ্গে যুদ্ধ করা। কেননা ভালো ও মন্দ কর্মের সূচনা হৃদয়ে উদিত চিন্তাভাবনা দ্বারাই হয়ে থাকে। হৃদয়ে ভালো কাজের ভাবনা উদয় হলে মুসলিম খুশি হবে, তা বাস্তবায়ন করে সফলতা অর্জন করবে। আর হৃদয়ে শয়তানের কুমন্ত্রণা জাগ্রত হলে সে আল্লাহর কাছে তা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করবে।

মানুষের সফলতা ও সৌভাগ্য নিহিত তার আত্মার নিয়ন্ত্রণ এবং জবাবদিহির মাঝে; কথাবার্তা ও কাজেকর্মে ছোটো-বড়ো প্রতিটি বিষয়ে আত্মার পর্যবেক্ষণের মাঝে। যে ব্যক্তি নিজের মনের হিসাব নেয় এবং আল্লাহর প্রিয় ও পছন্দের বস্তু দ্বারা নিজের কথা, কাজ ও চিন্তায় মনকে শাসন করে, সে সবচেয়ে বড়ো সফলতা অর্জন করে। আল্লাহ বলেন, ‘আর যে লোক তার প্রতিপালকের সামনে দায়মান হতে ভয় করে এবং প্রবৃত্তি থেকে নিজেকে বিরত রাখে, জান্নাতই হবে তার ঠিকানা।’ (সূরা নাজিয়াত : ৪০-৪১)।

আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। প্রত্যেক ব্যক্তি যেন চিন্তা করে আগামীকালের জন্য সে কী প্রেরণ করছে। আল্লাহকে ভয় করো। তোমরা যা করো, আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক অবগত।’ (সূরা হাশর : ১৮)।

আল্লাহ বলেন, ‘আমি শপথ করছি তিরস্কারকারী আত্মার।’ (সূরা কিয়ামাহ : ২)। মুফাসসিররা বলেন, ‘আল্লাহ ওই তিরস্কারকারী আত্মার কসম খেয়েছেন, যা দায়িত্বে অবহেলা করলে তিরস্কার করে, হারাম কাজে লিপ্ত হলে ভর্ৎসনা করে। মনের বিষয়টা সঠিক না হওয়া পর্যন্ত সে বেশি বেশি তিরস্কার করতে থাকে।’

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান আনে সে যেন উত্তম কথা বলে, নতুবা চুপ থাকে।’ (বোখারি ও মুসলিম)। আর আত্মার হিসাব নেওয়া ছাড়া এটা সম্ভব নয়। শাদ্দাদ ইবনে আওস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেন, ‘বুদ্ধিমান সে-ই যে নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং মৃত্যুর পরের সময়ের জন্য আমল করে। আর ব্যর্থ সে-ই যে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং আল্লাহর কাছে আশা করে বসে থাকে।’ ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) বলেন, ‘তোমাদের হিসাব নেওয়ার আগেই তোমরা নিজেদের হিসাব নাও, তোমাদের পরিমাপ করার আগে নিজেদের পরিমাপ করে নাও এবং সর্ববৃহৎ বিচারের জন্য প্রস্তুত হও।’

মায়মুন ইবনে মিহরান (রা.) বলেন, ‘কৃপণ লোক তার লেনদেনের অংশীদারের কাছে যতটুকু হিসাব নেয়, খোদাভীরু লোক তার চেয়ে বেশি নিজের মনের হিসাব নেয়।’ আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘মোমিন নিজের গোনাহগুলোকে এমন দৃষ্টিতে দেখে, যেন সে একটি পাহাড়ের মূলে দাঁড়িয়ে আছে, যা তার ওপর ভেঙে পড়ার ভয় পাচ্ছে সে। আর পাপী লোক তার গোনাহগুলোকে নাকের ওপর উড়ে এসে বসা মাছির মতো মনে করে, যেন হাত দিয়েই তা সরিয়ে দিতে পারবে।’ (বোখারি)।

মোমিন নিজের আত্মার জবাবদিহিতা করে, তাকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সুন্দরতম অবস্থায় তাকে ন্যস্ত করে। ফলে সে কাজকর্মের ক্ষেত্রে নিজের হিসাব নেয়, ইবাদত-বন্দেগিতে মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে, যেন পরিপূর্ণ নিষ্ঠার সঙ্গে তা আদায় করতে পারে। সেগুলো লোকদেখানোর ইচ্ছা, আমলের বড়াই ও মনগড়া পন্থার কলুষ থেকে মুক্ত থাকে। সে আমল দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখেরাত কামনা করে। সে নিজের মনের হিসাব নেয় যেন তা সৎকর্মে নিয়োজিত থাকে, তার আমল নবী করিম (সা.) এর সুন্নত অনুযায়ী হয় এবং সেসঙ্গে তার আমল স্থায়ী ও ধারাবাহিক হয়, নিরবচ্ছিন্ন অবিরাম হয়।

আল্লাহ বলেন, ‘এবং যারা আমার পথে চেষ্টা-সাধনা করে, আমি তাদের অবশ্যই আমার পথের দিশা দান করি। নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সঙ্গেই থাকেন।’ (সূরা আনকাবুত : ৬৯)। আল্লাহ আরও বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি আপনার প্রতি সত্যসহ এ কিতাব অবতীর্ণ করেছি। সুতরাং আল্লাহর ইবাদত করো তাঁর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে। জেনে রেখো, বিশুদ্ধ আনুগত্য আল্লাহরই প্রাপ্য।’ (সূরা জুমার : ২-৩)।

আল্লাহ বলেন, ‘বলুন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাস তবে আমার অনুসরণ করো, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন। তোমাদের গোনাহ ক্ষমা করবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল দয়ালু।’ (সূরা আলে ইমরান : ৩১)।

সুফিয়ান সাওরি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি আমার নিয়তের চেয়ে বেশি কঠিন কোনো জিনিসের সম্মুখীন হইনি; কেননা তা আমার কাছে বারবার রূপ পাল্টায়।’ কুতর ইবনে জিয়াদ বলেন, ‘আমি ইমাম আহমাদকে আমলের নিয়ত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম, বললাম, নিয়ত কেমন? তিনি বললেন, ‘মানুষ কোনো আমল করতে চাইলে নিজেকে এমনভাবে প্রস্তুত করবে যেন তার দ্বারা মানুষকে দেখানোর ইচ্ছা না হয়।’

শাদ্দাদ ইবনে আওস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যে লোকদেখানোর জন্য নামাজ পড়ল, সে শিরক করল। যে লোকদেখানোর জন্য রোজা রাখল, সে শিরক করল। যে মানুষকে দেখানোর জন্য দান করল, সে শিরক করল।’ (আহমাদ ও হাকেম)।

মোমিন ব্যক্তি নিজের কথাবার্তার ক্ষেত্রেও মনের জবাবদিহিতা করবে। ফলে সে তার জিহ্বাকে অন্যায় ও হারাম কথায় ব্যবহার করবে না। সে যেন স্মরণ রাখে, তার সঙ্গে দুজন ফেরেশতা নিয়োজিত করা আছে, তারা তার জিহ্বা দ্বারা উচ্চারিত প্রত্যেক কথাই লিখে রাখে। তার প্রতিটি আমল লিপিবদ্ধ করে। এর ভিত্তিতে তাকে সওয়াব বা শাস্তি প্রদান করা হবে। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য লিপিবদ্ধকারী সম্মানিত প্রহরীরা নিযুক্ত আছে, তোমরা যা করো তারা তা জানে।’ (সূরা ইনফিতার : ১০-১২)।

আল্লাহ আরও বলেন, ‘সে যে কথাই বলে তার জন্য একজন তৎপর প্রহরী আছে।’ (সূরা কাফ : ১৮)। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘সে তার ভালো-মন্দ প্রত্যেক কথা লিখে রাখে, এমনকি সে তার এ কথাগুলোও লিখে রাখে আমি খেয়েছি, পান করেছি, গিয়েছি, এসেছি, দেখেছি।’

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেন, ‘মানুষ তার মনের অগোচরে আল্লাহর সন্তোষজনক এমন কথা বলে ফেলে, যার দ্বারা আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। আবার কখনও মানুষ তার মনের অজান্তে আল্লাহর অসন্তোষজনক এমন কথা বলে ফেলে, যার দ্বারা তাকে জাহান্নামে নিয়ে যায়।’ (বোখারি)।

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘আল্লাহর কসম, তিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। পৃথিবীতে জিহ্বাই দীর্ঘ সময় আটক থাকার সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত।’ আবু বকর (রা.) নিজের জিহ্বা টেনে ধরে বলতেন, ‘এটাই আমাকে বিভিন্ন সমস্যার স্থানে নিয়ে এসেছে।’

তদ্রপ মুসলিম ব্যক্তির উচিত হলো হৃদয়ে উদয় হওয়া চিন্তা, ভাবনা ও বিভিন্ন কুমন্ত্রণার ক্ষেত্রেও নিজের মনের হিসাব নেওয়া ও এর সঙ্গে যুদ্ধ করা। কেননা ভালো ও মন্দ কর্মের সূচনা হৃদয়ে উদিত চিন্তাভাবনা দ্বারাই হয়ে থাকে। হৃদয়ে ভালো কাজের ভাবনা উদয় হলে মুসলিম খুশি হবে, তা বাস্তবায়ন করে সফলতা অর্জন করবে। আর হৃদয়ে শয়তানের কুমন্ত্রণা জাগ্রত হলে সে আল্লাহর কাছে তা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করবে। ফলে সে গোনাহ ও অন্যায় থেকে মুক্ত থাকবে। এ ব্যাপার উদাসীন হলে সে পাপ ও হারাম কাজে জড়িয়ে পড়বে।

আল্লাহ বলেন, ‘যদি শয়তানের পক্ষ থেকে কোনো কুমন্ত্রণা তোমাকে আক্রান্ত করে, তখন তুমি আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করো। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।’ (সূরা হামিম সিজদা : ৩৬)। আল্লাহ সূরা নাসে এ প্রকাশ্য শত্রু থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করার আদেশ দিয়েছেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই শয়তান আদম সন্তানের হৃদয়ে অধোমুখ হয়ে থাকে, সে যদি আল্লাহর জিকির করে তখন পালিয়ে যায়, আর যদি উদাসীন থাকে তাহলে কুমন্ত্রণা দেয়।’ আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘শয়তান মানুষের হৃদয়ে তার লাগাম লাগিয়ে রাখে, আল্লাহকে স্মরণ করলে সে পালিয়ে যায়। আর আল্লাহর স্মরণ ভুলে গেলে তার অন্তরকে গ্রাস করে। শয়তান সে তো কুমন্ত্রণাদাতা ও আত্মগোপনকারী।’ (আবু ইয়ালা মুসিলি)।

পরিশেষে, যে নিজের খেয়ালি মনের হিসাব নেবে ও তার সঙ্গে যুদ্ধ করবে, সে দুনিয়ায় প্রশংসিত হয়ে আখেরাতে সৌভাগ্যবান হবে। পক্ষান্তরে যে নিজের প্রবৃত্তির দাসত্ব করবে, সে পাপে লিপ্ত হয়ে পরকালে শাস্তি ভোগ করবে।

২১ জিলকদ ১৪৩৯ হিজরি মসজিদে নববির জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর করেছেন
মাহমুদুল হাসান জুনাইদ

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর